গত মঙ্গলবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে ‘৩৬ জুলাই উদ্?যাপন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এরইমধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র অপূর্ণাঙ্গ বিবৃতির মতো প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। একইসুরে কথা বলেছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। তবে ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং জনতা পার্টি বাংলাদেশের নির্বাহী চেয়ারম্যান গোলাম সারোয়ার মিলন ও মহাসচিব শওকত মাহমুদ। তবে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করার পর পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতামত তুলে ধরছেন রাজনীতিবিদরা। শুধু রাজনীতিবিদরাই নয়, দেশের সকল পেশা-শ্রেণির মানুষের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি করেছে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। তারা মনে করছেন, গত ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল ছাত্র-জনতা। অবশেষে সেই দাবি বাস্তবায়বে রূপ নেওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তারা।
জানা গেছে, জুলাই ঘোষণাপত্র হচ্ছে-২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের একটি দলিল, যার মাধ্যমে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। সেই ধারাবাহিকতা রক্ষায় মঙ্গলবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে ‘৩৬ জুলাই উদ্?যাপন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও ছাত্র-জনতা উপস্থিত ছিলেন। ২৮ দফা এ ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে, ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে। ৫ অগাস্ট ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে।
এদিকে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে ৫ আগস্ট কোনো মন্তব্য করেনি বিএনপি। তবে গতকাল বুধবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, মানুষের সেই সংঘবদ্ধ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূত আন্দোলনের মধ্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় ফ্যসিস্ট হাসিনা ৫ আগস্ট। এই অভ্যুত্থানের ফলে মানুষের মনে নতুন আশা আবারো সৃষ্টি হয় এক নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজনৈতিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে নতুন করে গড়ে তোলার লক্ষে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের কাজ শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার প্রফেসর ইউনূস ৫ আগস্ট জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, বিএনপি বিশ্বাস করে এই ঘোষণাপত্রে রাজনৈতিক দলগুলো যে অঙ্গীকার করেছে তা পালনের মধ্যদিয়ে এক নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে রূপান্তরের কাজ শুরু হবে। সুযোগ সৃষ্টি হবে একটি সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে সত্যিকারের প্রগতিশীল সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণের প্রক্রিয়া। বিএনপি যে সকল রাজনৈতিক দল, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকসহ সকল স্তরের জনগণ এই সংগ্রামে অংশ নিয়েছে, শহীদ হয়েছে, আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে তাদের জানাচ্ছে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন জনতা পার্টি বাংলাদেশের নির্বাহী চেয়ারম্যান গোলাম সারোয়ার মিলন এবং মহাসচিব শওকত মাহমুদ। গতকাল বুধবার এক যুক্ত বিবৃতিতে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তবে জুলাই সনদে তথা সংস্কারের বিষয়ে সার্বিক ঐকমত্যের পূর্বে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণার বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে এবং জুলাই ঘোষণার মূল দাবি উত্থাপনকারী ছাত্র নেতাদের মঙ্গলবার মঞ্চে অনুপস্থিতি সকল সংশয়ের অবসানের ইঙ্গিতবহ নয়। বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় বলেন, জাতির উদ্দেশে ভাষণে ড. ইউনূসের নির্বাচন বিষয়ক সুস্পষ্ট ঘোষণা নিশ্চিতভাবেই বহু অনিশ্চয়তার আশঙ্কা দূর করেছে। গণতন্ত্র উত্তরণে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। ইউনূস সরকার সে পথেই হাঁটতে শুরু করেছে। তবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের সার্বিক সাফল্যের ক্ষেত্রে সকল অংশীজনের প্রত্যাশা পূরণকে অনিষ্পন্ন রেখে নির্বাচনী ট্রেনে ওঠার যে তাড়াহুড়া তাতে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। একই সঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি দৃশ্যমান বিচার ও জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের দাবিও জানিয়েছে এবি পার্টি।
এদিকে, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান না নিয়ে বরং মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। তিনি বলেছেন, আমি পুরোপুরি খুশি নই, আবার একে পুরোপুরি অস্বীকারও করছি না। বুধবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের আলরাজী কমপ্লেক্সে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। নুর বলেন, পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট এসেছে ১৩৩ জন শিশু মারা গেছে। এরা কী কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিল? যারা জীবন দিয়েছে তারা কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ। অথচ তাদের লাশের ওপর দিয়ে এখন অনেকে এমপি হচ্ছেন, উপদেষ্টা হচ্ছেন, ক্ষমতার রাজনীতি করছেন। কোনো বড় নেতার সন্তান কি এই আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছে? তিনি আরও বলেন, এই ইতিহাস সাধারণ মানুষের। অথচ অনেকে আন্দোলনের মাত্র ১০-১৫ দিনের মধ্যেই হিরো বনে যাচ্ছেন। সেই হিরোরা এখন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে তথাকথিত ‘কিংস পার্টি’ বানিয়ে তরুণদের বিভ্রান্ত করছে। নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন যারা দেখেছিল, তারাই এখন জড়িয়ে পড়ছে লুটপাট, তদবির, চাঁদাবাজিতে। এসব ইতিহাসেরও বিচার হবে। নুর দাবি করেন, আগামীতে যে জুলাই সনদ ঘোষণা করা হবে, তাতে সব অংশগ্রহণকারী ও শহীদদের প্রকৃত ত্যাগের মূল্যায়ন থাকতে হবে। ঘোষণাপত্রকে জাতীয় মুক্তির সনদ হিসেবে রূপ দিতে হবে, দিতে হবে আইনি ভিত্তি। সবাইকে নিয়ে আলোচনা করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক দলিল তৈরি করতে হবে। জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার পাঠ করা এই ঘোষণাপত্র একটি অপূর্ণাঙ্গ বিবৃতি। এতে গণমানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। ঘোষণাপত্রে দীর্ঘ লড়ায় সংগ্রামের কথা উল্লেখ করা হলেও ১৯৪৭ সালের আজাদীকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এতে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা হত্যাকাণ্ড, ২৮ অক্টোবরের হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ নেই। বুধবার দুপুরে মগবাজার আল-ফালাহ মিলনায়তনে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে জামায়াতে ইসলামী। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের এ প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আর যেন ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে, আবারো যেন সেই দুঃশাসন ফিরে আসতে না পারে, দেশে ইনসাফপূর্ণ, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ কায়েম হবে-সেই আকাক্সক্ষা ছিল জনগণের। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সভা-সমাবেশ করার অধিকার, বাক-স্বাধীনতা, ভোটাধিকার নিশ্চিত হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে আপামর জনসাধারণ। সেই প্রত্যাশাকে সামনে রেখেই জনগণ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছে। জুলাই আন্দোলন সংগ্রামের ঘটনাকে ধারণ করে জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই জাতীয় সনদের দাবি সর্বমহলের। এ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপ করেছে। তাহের বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় গতকাল অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ২৮ দফার জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাপত্র একটি অপূর্ণাঙ্গ বিবৃতি। এতে গণমানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। ঘোষণাপত্রে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের কথা বলা হলেও ১৯৪৭ এর আজাদীকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এতে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা হত্যাকাণ্ড, ২৮ অক্টোবরের হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ নেই। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আলেম-ওলামা, মাদ্রাসা শিক্ষক ও ছাত্র, প্রবাসী ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের ভূমিকার উল্লেখ নেই, যা ইতিহাসের প্রতি অবিচার ও অবহেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। জুলাই অভ্যুত্থানের টার্নিং পয়েন্ট ছিল ৯ দফা যা এক দফায় রূপান্তরিত হয়েছিল, সে বিষয়টিও ঘোষণাপত্রে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রধান আকাক্সক্ষা ছিল রাষ্ট্র সংস্কার। এজন্য ৬টি কমিশন গঠন এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দুই পর্বের দুই মাসেরও বেশি সময় যে কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে এবং ১৯টি বিষয়ে ঐকমত্যের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অথচ প্রধান উপদেষ্টার পঠিত জুলাই ঘোষণাপত্রে তার উল্লেখ নেই। ঘোষণায় কখন কীভাবে তা কার্যকর করা হবে তা উল্লেখ না করে ঘোষণাকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে। পরবর্তী সরকারের হাতে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়ায় হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত জুলাই চেতনা ও আশা-আকাক্সক্ষা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামীর এ শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত টাইমলাইন অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তার আইনি ভিত্তি দিতে হবে। অতীতে বিভিন্ন অভ্যুত্থান ও আন্দোলন হয়েছে-পরবর্তী সময়ে তার আইনিভিত্তি দেওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন- ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর লিগাল ফ্রেম ওয়ার্কের ভিত্তিতে ৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদে ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুমোদন হয়েছিল। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ১০ মাস মুজিবনগর সরকারের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সরকার গঠনের পূর্ব পর্যন্ত ৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ ও দেশ পরিচালনা, দল গঠন, সামরিক প্রশাসক থেকে প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব গ্রহণসহ ’৭৫ থেকে ’৭৯ পর্যন্ত শাসনকালের গণভোট, অধ্যাদেশ জারি করে তার ক্ষমতায় আরোহণ ও দেশ পরিচালনার মতো বৈধতা দিয়েছিল, যা পরবর্তী সংসদ অনুমোদন করে। উপরন্তু ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের পর তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তার আইনি ভিত্তি না থাকায় এ রূপরেখার অন্যান্য বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হয়নি। অতীতে এত নজির থাকার পরও এখন জুলাই জাতীয় ঘোষণাপত্রের আইনি ভিত্তি দিতে বাধা কোথায়? আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন দ্রুত সম্পন্ন করে অধ্যাদেশ, এলএফও বা গণভোটের মাধ্যমে আইনিভিত্তি দেওয়া না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম বিফলে যাবে বলে জানান তিনি। তাই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বাহিনী ও সংস্থার কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ও প্রশাসনের মধ্যে স্বৈরাচারের দোসরদের মুক্ত করতে হবে। নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনের সব স্তরের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে ডেভিড বার্গম্যানের অভিমত: জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে নিজের অভিমত দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। মঙ্গলবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণাপত্র পাঠ করার পর তিনি এক ফেসবুক পোস্টে এ অভিমত জানান। ফেসবুক পোস্টে বার্গম্যান লিখেছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আজ “জুলাই ঘোষণাপত্র” পাঠ করেছেন। এই ঘোষণাপত্র নিয়ে আমার প্রাথমিক মতামত হলো-১. এই ঘোষণাপত্রে তুলে ধরা ইতিহাসের বেশির ভাগ অংশ-একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ নিয়ে বর্ণনা অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট ও একতরফা। যারা আওয়ামী লীগকে ঘৃণা করেন, এতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। এই ঘৃণা দলটি সরকারে থাকাকালে যা করেছে শুধু সে জন্য নয়, বরং দলটি সম্পর্কে তাদের মনোভাবের জন্য-এটাকে একটি রাজনৈতিক বৈরিতা বলা যায়। ঘোষণাপত্রের অনেকটাই পড়ে মনে হয়, যেন এটি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের বিরোধী ও সমালোচকদের লেখা একটি রাজনৈতিক বক্তব্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, সংবিধানের তফসিলে জুলাই ঘোষণাপত্রের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলায় তার ‘প্রায়োগিক বাধ্যবাধকতা থাকল না’। তার মতে, বর্তমান সরকার ‘নির্বাচিত’ না হওয়ায় ত্রয়োদশ নির্বাচনের মাধ্যমে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবে, তাদের বিরোধিতার মুখে ঘোষণাপত্রটি বদলানোর সুযোগ থাকছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তফসিল হলো সংবিধানের অংশ, কিন্তু তার কোনো প্রায়োগিক বাধ্যবাধকতা নাই। তফসিলের ধরনের উপরে নির্ভর করে, এইটা কী হবে। যদি ঘোষণাপত্র তফসিলে আসে তাহলে এর কোনো প্রায়োগিক বাধ্যবাধকতা নাই। থাকবে না। আর এটা, এখন যদি আপত্তি করে, বলে-না এই শব্দ আমার পছন্দ না। মানে সংসদের বিতর্কের সময়, এইটা আমার পছন্দ না, ওইটা আমার পছন্দ না। তখন কী হবে? তখন এটাকে কাটাছেঁড়া করতে হবে। সবাই তো এটাকে একবারে ১০০ শতাংশ মানতে নাও পারে। যখন সংসদে আসবে, কোন দলে কত সদস্য থাকে, কার কী মত থাকে, সবাই তো এটার সাথে একমত নাও হতে পারে। ঠিক প্রত্যেকটা শব্দ যেভাবে লিখা হয়েছে তার সাথে একমত নাও থাকতে পারে। মূল উদ্দেশ্য হলো-সংবিধানের ধারাগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য এই কথাগুলো স্মরণে রাখতে হবে। এই কথাগুলোর উপর ভিত্তি করে সংবিধান ব্যাখ্যা করা হবে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ বা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামের যে রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তার সাংবিধানিক ভিত্তি হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। তবে জুলাই ঘোষণাপত্রের ‘সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকা উচিত’ বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম। তিনি বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকা উচিত। সংবিধানে কীভাবে থাকবে, তা নিয়ে দলগুলোর ভিন্নমত থাকলেও এ ঘোষণাপত্রের আলোকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তা না হলে ‘বিপদ’ দেখছেন তিনি। এইটাই মূল পয়েন্ট। এটি নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত; এটার একটা স্বীকৃতি থাকা উচিত। যেহেতু আমরা ১৯৭১ সালে আমাদের যে আন্দোলন, যে যুদ্ধ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, এটাকে আমরা আমাদের স্বাধীনতা এবং জুলাই ২০২৪ কে আমরা বলছি ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা-বাংলাদেশ ভার্সন টু’ তার এটা একটা স্বীকৃতি থাকা দরকার। তিনি বলেন, আরেকটা বড় জিনিস হচ্ছে-এটার চেতনা, তাৎপর্য ধারণ করা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যেকেরই এই যে ঘোষণাপত্রটা, এটার চেতনা, এটার তাৎপর্যটাকে ধারণ করা জরুরি। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোকে এই ঘোষণাপত্রের আলোকে দেশ গঠনে একসঙ্গে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন তিনি। ঘোষণাপত্রকে ‘গণঅভ্যুত্থানেরই অর্জন’ বলে দাবি করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তার ভাষ্য, সে কারণে এর আকাক্সক্ষাকে আমরা পূর্ণভাবে ধারণ করি। মুক্তিযুদ্ধসহ এদেশের মানুষের শত শত বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এই অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে আমরা মনে করি। কিন্তু এই আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়ন না করা হলে অতীতের মতোই পুরোনো বন্দোবস্ত আবারো ফেরত আসবে, জনগণকে অধিকারহীন করবে। তার মতে, ন্যায়বিচার, সংস্কার, নির্বাচনের পথেই শহীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। জনগণ ‘জেগে’ থাকলে ‘ফ্যাসিবাদ’ আর ফেরত আসতে পারবে না। এর আগে ২৯ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নাৎসি বাহিনীর মতো অপ্রাসঙ্গিক এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের ‘কবর’ রচনা করা হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

* জুলাই ঘোষণাপত্র অপূর্ণাঙ্গ বিবৃতির মতো প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি জামায়াত * জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে খুশি নই, আবার অখুশিও নই: নুর * জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে ডেভিড বার্গম্যানের অভিমত
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানামত
- আপলোড সময় : ০৭-০৮-২০২৫ ০৬:৩৬:২২ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৭-০৮-২০২৫ ০৬:৩৬:২২ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ